নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কি এবং এর ইতিহাস ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:

প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ৫ বা ১০ বছরের পুরনো ইন্ডাস্ট্রি নয়। এটি প্রায় শত বছেরের পুরানো ইন্ডাস্ট্রি ।

 

নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) এর বাংলা পরিভাষা হচ্ছে বহুমুখী পণ্য বিপণন পদ্ধতি। এটি মূলত মধ্যস্বত্ত্বভুগীদেরকে (যেমনঃ এজেন্ট-পাইকারী বিক্রেতা-খুচরা বিক্রেতা) বাদ রেখে সরাসরি কাস্টমারের কাছে পণ্য বিক্রয় করে এবং কোন ক্রেতা যদি তার নিকটাত্বীয় বা বন্ধুদের কাছে বিক্রয় সহযোগীতা করেন তাহলে এর লাভের একটা অংশ পুনরায় কমিশন আকারে ফেরত দেওয়েই হচ্ছে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) এর মূল ব্যবসা । আর এই পুরো সিস্টেমটাকেই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) বলা হয় ।

 

ব্যবসাটি দলগতভাবে করা হয় বিধায় একে অপরের সহযোগিতায় কাজটি অনেক সহজ হয় এবং পন্য বিক্রয় হয় দ্রুত গতিতে । এটি মূলত ১ জন থেকে ২জন, ২ জন থেকে ৪ জন, আবার ৪ জন থেকে ৮ জন, এভাবেই এর পরিধি বাড়তে থাকে । একসময় এটি বিশাল জনগোষ্টিতে পরিনত হয় ।

 

এই পদ্ধতিটি ১৯২০ সালে আমেরিকার একজন ফেরিওয়ালা প্রথম আবিষ্কার করেন, যার নাম হেনরি হেইনজ । পরবর্তীতে, ড. কার্ল রেইনবর্গ আধুনিক এমএলএম-এর জন্ম প্রবর্তন করেন ১৯৩০ সালের দিকে। ১৯৩৪ সালে দিকে তিনি কেলিফোর্নিয়া ভিটামিন কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং মাল্টিভিটামিন বা ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রয় শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে কোম্পানিটির তার নাম পরিবর্তন করে নিউট্রিলাইট প্রডাক্টস ইনকর্পোরেশন নামকরণ করেন। বর্তমানে কোম্পানিটি এভন প্রডাক্টস ইনকরপোরেশন নামে পরিচিত।

 

তারপর ১৯৪৯ সালে তাদের এই কোম্পানিতে দুজন ডিসট্রিবিউশন যুক্ত হন, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, জে ভেন এন্ডেল এবং দ্বিতীয় জন রিচ ডিভস । পরের ১০ বছর তারা খুব দক্ষতার সাথে কাজ করেন। এরপর তারা তাদের ব্যাবসা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর এই দুজন মিলে ১৯৬০ সালে নতুন আরেকটি কোম্পানি তৈরি করে যাকে আপনারা এমওয়ে নামে চিনেন। এই কোম্পানিটির আসল নাম হলো দি এমেরিকান ওয়ে ।

১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় বিলের মাধ্যমে মাত্র ১০ ভোট বেশি পেয়ে এই ব্যবসা আইনগত স্বীকৃতি পেলে এর বিকাশ সারা বিশ্বে আরও দ্রুততর হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে ব্যপকহারে ব্যবসা পরিচালনা শুরু হয় ।

 

আরও পড়ুনঃ জীবন পরিবর্তনকারী সেরা ৫ টি অনুপ্রেরনা মূলক গল্প

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম):

১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত জনাব নারায়ণ দাস নামের এক ব্যক্তি কানাডার মাধ্যম হয়ে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে এসে এমএলএম ব্যবসার আবির্ভাব ঘটান। তিনি বাংলাদেশে এসে জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক কোম্পানির মাধ্যমে এমএলএম চর্চা শুরু করেন। পরবর্তীতে কোম্পানিটি ভেঙ্গে নিউওয়ে প্রাইভেট বাংলাদেশ লি: এবং ডেসটিনি-২০০০ লি: নামের আরো দুইটি কোম্পানির জন্ম হয়। এরপরেই বাংলাদেশে এই পদ্ধতির ব্যপক কার্যক্রম শুরু হয়। ডেসটিনি-২০০০ লি: নামের কম্পানিটি প্রথমের দিকে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে পার হলেও পরের দিকে খুব ভালভাবেই চলছিল ২০১২ সাল পর্যন্ত। কম্পানিটির কর্নধার জনাব মোহাম্মদ হোসাইন এবং রফিকুল আমিনের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে কম্পানিটির ৪৫ লক্ষ ক্রেতাপরিশেক তৈরি হলেও বিভিন্ন অনিয়ম ও অর্থ কেলেংকারির দায়ে দুইজনইকেই কারা বরন করতে হয়েছে । এরপর বাংলাদেশে শুরু হয় এটাকে নিয়ে বিতর্ক।

 

অবশেষে ২০১৩ সালে এমএলএম আইন পাস হয় এবং আইন তৈরি হয় যা ২০১৩ সালের ৪৪ নং আইন। মহান জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৯ আগস্ট, ২০১৩ সোমবার মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইন প্রনয়নের জন্য বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে বলে জানা গেছে ।

 

২০১৪ সালের মার্চ মাসের দিকে কিছু কোম্পানিকে সরকার লাইসেন্স দিলেও ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে সব এমএলএম কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া হয়।এরপর থেকে কিছু কোম্পানি কোর্টের মাধ্যমে স্টে অর্ডার নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে সরকার এটিও বন্ধ করে রেখেছে এবং নতুন করে কোন কোম্পানিকে কোর্টের মাধ্যমে স্টে অর্ডার নিয়ে ব্যবসা পরিচালনারও অনুমতি দিচ্ছে না । ফলে, প্রতিনিয়ত নেতিবাচকদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করে যেতে হচ্ছে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কর্মী ও মালিকগণদের।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে পাচঁ শতাধিকেরও বেশী কম্পানি বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যেদিয়ে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) ব্যাবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে । এর মধ্যে কিছু কিছু কম্পানি আবার ই-কর্মাস বা অন্যন্য নামে তাদের নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ।

 

সর্বোপরি, সরকারের সঠিক গাইডলাইন পেলে বাংদেশের অর্থনিতিতে ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) কোম্পানিগুলোর । সাথে দেশের বেকার সমস্যা দূরিকরনের ক্ষেত্রেও দারুন ভূমিকা রাখতে পারে ।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কি এবং এর ইতিহাস ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট :

নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কি এবং এর ইতিহাস