সফল উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, লেখক, বিজ্ঞানী – যার কথাই বলা যাক, সবাইকেই ব্যর্থতার কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে সফল হতে হয়েছে। আবার এই সাফল্য পাওয়ার পরও অনেকে আবার ব্যর্থ হয়েছেন। আবারও তাঁরা উঠে দাঁড়িয়েছেন, এবং আবার সফল হয়েছেন। প্রতিটি গল্প থেকেই অনুপ্রেরণা নেয়ার মত কিছু না কিছু আছে। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর সেরা সফল ১০ জন মানুষের ব্যর্থতার কাহিনী।
০১.আব্রাহাম লিংকন: ব্যর্থতার পথ পাড়ি দিয়ে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক নেতা
১৮০৯ সালে জন্ম নেওয়া আব্রাহাম লিংকন শুধু আমেরিকার নয়, বরং বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ও সম্মানিত রাষ্ট্রনায়ক। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট, এবং আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার জন্য তাঁকে চিরকাল স্মরণ করা হয়। তবে তাঁর এই সাফল্যের যাত্রাপথ একেবারেই সহজ ছিল না। বরং, তাঁর জীবনের শুরুটাই ছিল ব্যর্থতায় ভরা – কিন্তু সেই ব্যর্থতাই তাঁকে তৈরি করে ইতিহাসের মহান নেতা হিসেবে।
লিংকনের জীবনে ব্যর্থতার শুরু ২৩ বছর বয়সে, যখন তিনি চাকরি হারান এবং একই সময়ে একটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। এরপর একের পর এক রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় তাঁকে হতাশা সইতে হয়। ২৯ বছর বয়সে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। ৩৯ বছর বয়সে ওয়াশিংটনের জেনারেল ল্যান্ড অফিসের কমিশনার হওয়ার জন্য লড়াই করে সফল হতে পারেননি। এমনকি ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর পদেও তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরেও তিনি দমে যাননি। বারবার প্রত্যাখ্যাত হলেও হাল ছাড়েননি। অবশেষে ১৮৬১ সালে, ৫২ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আমেরিকা এক নতুন অধ্যায় শুরু করে – যেখানে মানুষ, জাতি, ও মানবতা নতুন সংজ্ঞা পায়।
লিংকনের গল্প প্রমাণ করে যে, বারবার ব্যর্থ হওয়া মানেই থেমে যাওয়া নয়। ধৈর্য, অটল মানসিকতা এবং উচ্চ উদ্দেশ্য থাকলে – ব্যর্থতার পথ পেরিয়েও মানুষ ইতিহাস গড়তে পারে।
০২. আলবার্ট আইনস্টাইন: ‘ডাল ব্রেন’ থেকে যুগান্তকারী বিজ্ঞানী
আলবার্ট আইনস্টাইন—পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ। ১৮৭৯ সালে জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটিকে আজ আমরা ‘জিনিয়াস’ বলি, কিন্তু তাঁর জীবনের শুরুটা ছিল অবিশ্বাস্যরকম কঠিন ও অবমূল্যায়নে ভরা।
শিশু বয়সে আইনস্টাইনকে অনেকেই বুদ্ধিহীন মনে করত। কথা বলতেই তিনি শিখেছিলেন ৪ বছর বয়সে। পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ কম ছিল না, তবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি বলেই সবসময় পিছিয়ে থাকতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও প্রায় প্রতিটি বিষয়ে খারাপ ফল করতেন। এতটাই হতাশ ছিলেন যে একাধিকবার পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। এমনকি, তাঁর মৃত্যুশয্যায় থাকা বাবা দুঃখ করে বলেছিলেন—”এই ছেলেটা জীবনে কিছুই করতে পারবে না।” এই কথাটি আইনস্টাইনের হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধরে বেদনার দাগ কেটে রেখেছিল।
চাকরির জন্য বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। অবশেষে বাধ্য হয়ে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে সেলসম্যানের কাজ নেন—সেই সময়ের সবচেয়ে সাধারণ ও অবমূল্যায়িত পেশাগুলোর একটি। দুই বছর পর চাকরি পান একটি পেটেন্ট অফিসে, যেখানে নতুন আবিষ্কারের আবেদন মূল্যায়ন করতে হতো।
এই নিরিবিলি কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি ভাবতে থাকেন মহাবিশ্ব, সময়, ও স্থান নিয়ে। আর সেই চিন্তার ফসল হিসেবেই তিনি আবিষ্কার করেন আপেক্ষিকতার তত্ত্বসহ পদার্থবিজ্ঞানের একের পর এক যুগান্তকারী সূত্র। তাঁর অসাধারণ গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেন নোবেল পুরস্কার।
একসময় যাঁকে ‘গর্ধভ’ বলা হতো, সেই মানুষটিই পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীর ভাবনার ধারা পাল্টে দেন—প্রমাণ করে দেন, চেষ্টা ও অধ্যবসায় থাকলে ‘ডাল ব্রেন’ও একদিন আলোকিত করতে পারে গোটা পৃথিবীকে।
০৩. বিল গেটস: অপমানের মাঝেও যে উঠে দাঁড়ান
যদিও আজকের দিনে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর আসনটি দখল করে আছেন জেফ বেজোস, কিন্তু বিল গেটসের নাম এখনও অনেকের মনেই বিশ্বের ‘চিরকালীন ধনী’ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। কারণ, টানা বহু বছর তিনিই ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল কম্পিউটার বিপ্লব—যা বদলে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর চালচিত্র।
মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটি আজ যতই সফল হোন, তাঁর যাত্রাটা শুরু হয়েছিল একটি ব্যর্থতার গল্প দিয়ে।
বাল্যবন্ধু পল অ্যালেনকে সঙ্গে নিয়ে বিল গেটস একসময় তৈরি করেছিলেন একটি প্রজেক্ট—Traf-O-Data। এই যন্ত্রটি বানানো হয়েছিল ট্রাফিক কাউন্টারের ডাটা বিশ্লেষণ করে তা স্থানীয় সরকারি প্রকৌশলীদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। সে সময় এমন কাজ মানুষকে হাতে করতে হতো, তাই তাঁরা চেয়েছিলেন এটিকে অটোমেট করতে।
যন্ত্রটির উদ্বোধনের দিন উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং সিয়াটলের ট্রাফিক সুপারভাইজার। সবাই যখন উৎকণ্ঠায় চেয়ে আছে—যন্ত্রটি চালু হওয়ার পর দেখা গেল, সেটি একেবারেই কাজ করছে না। মুহূর্তেই পুরো আয়োজনটা পরিণত হয় অপমানে। এমন ব্যর্থতা ও লজ্জা বিল গেটসের জীবনে আর কখনও আসেনি।
কিন্তু এখানেই তাঁদের গল্প থেমে যায়নি। এই অপমানের মাঝেও তাঁরা হাল ছাড়েননি। শিক্ষা নিয়েছেন, উন্নতি করেছেন, এবং পরে গড়ে তুলেছেন সেই মাইক্রোসফট—যা আজও বিশ্বের কোটি কোটি কম্পিউটার চালানোর পেছনে সবচেয়ে বড় নাম।
বিল গেটস আমাদের দেখিয়েছেন—প্রথম ধাক্কায় পড়ে যাওয়া মানেই পরাজয় নয়। যদি সাহস থাকে, তবে ব্যর্থতাও হয়ে উঠতে পারে সাফল্যের সিঁড়ি।
০৪. জ্যাক মা: ব্যর্থতার পাহাড় টপকে সাফল্যের শিখরে
চীনের প্রভাবশালী ধনকুবের ও আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা—এ নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়, এমন মানুষ খুব কমই আছে। সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি আজ বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা। কিন্তু তাঁর জীবনের শুরুটা ছিল যেন এক দীর্ঘ ব্যর্থতার উপন্যাস।
শিক্ষাজীবনের শুরুতেই হোঁচট। কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে তিনবার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেন, চতুর্থ চেষ্টায় সুযোগ মেলে। এরপর চাকরির বাজারে নেমে যে অভিজ্ঞতা পেলেন, তা আরও করুণ।
চীনের পুলিশ বাহিনীতে চাকরির জন্য আবেদন করেন – ১০ জনের মধ্যে ৯ জন চাকরি পায়, বাদ যান একমাত্র জ্যাক মা।
কেএফসিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন ২৪ জন – ২৩ জনকে নেয়া হয়, বাদ যান শুধুমাত্র জ্যাক।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেন ১০ বার, কিন্তু একবারও সুযোগ পাননি।
এভাবে শত ব্যর্থতা, অপমান, ও প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তিনি হাল ছাড়েননি। নিজেকে বারবার তৈরি করেছেন, ভেঙেছেন ও গড়েছেন।
অবশেষে, সকল ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে জ্যাক মা গড়ে তোলেন “আলিবাবা”—যা আজ বিশ্বের অন্যতম বড় প্রযুক্তি ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।
জ্যাক মার গল্প আমাদের শেখায় – সফলতা কখনো হঠাৎ আসে না। বারবার পড়ে গিয়ে যে মানুষ উঠে দাঁড়ায়, সাফল্য একদিন ঠিকই তাঁর দরজায় কড়া নাড়ে।
০৫. চার্লি চ্যাপলিন: কাঁটার পথ পেরিয়ে হাসির রাজা
চার্লি চ্যাপলিন—একটি নাম, যা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একজোড়া কালো টুপি, লাঠি, আর হাজারো মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সেই কমেডি কিংবদন্তি। ১৮৮৯ সালে জন্ম নেওয়া এই ব্রিটিশ অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক নিঃসন্দেহে সিনেমা জগতের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্রগুলোর একজন।
কিন্তু এই অমর মানুষের জীবন শুরু হয়েছিল ভয়ংকর দুঃখ, অনাহার ও অসহায়তার মধ্য দিয়ে।
চ্যাপলিনের বাবা ছিলেন একজন মাদকাসক্ত গায়ক, যিনি কোনও কাজ না করে মদ খেয়ে দিন কাটাতেন। মাত্র ২ বছর বয়সে চার্লিকে বাবা ছেড়ে চলে যান। মা ছিলেন নাট্যশিল্পী, তবে তাঁর আয় এত অল্প ছিল যে সংসার চালানো তো দূরের কথা, দুই বেলা খাবারই ছিল অনিশ্চিত।
৭ বছর বয়সে চার্লিকে পাঠানো হয় “ওয়ার্কহাউজ”-এ—একটি বিশেষ ব্যবস্থা, যেখানে গরিব শিশুরা কষ্টের বিনিময়ে আশ্রয় ও অল্প খাবার পেত।
এরপর কিছুদিনের জন্য বাড়ি ফিরে এলেও, ৯ বছর বয়সে তাঁর মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে ভর্তি করা হয় মানসিক হাসপাতালে। ফলে চার্লির আবার ফিরে যেতে হয় সেই নির্মম ওয়ার্কহাউজে।
এর মধ্যেই তাঁর বাবা লিভারের সমস্যায় মারা যান। আর মায়ের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে তাঁকে আজীবনের জন্য পাগলা গারদে পাঠাতে হয়।
চার্লি ও তাঁর ভাই সিডনি তখন একেবারে পথে বসে যান। না খেয়ে দিন কাটানো, ফুটপাতে ঘুমানো—এই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন জীবন।
তবে এখানেই থেমে থাকেননি চার্লি। জীবন যুদ্ধে হেরে যাননি।
একটি মঞ্চনাটকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ধীরে ধীরে তাঁর অনন্য কমেডি প্রতিভা নজরে আসে সবার। মঞ্চ থেকে সিনেমায়, ব্রিটেন থেকে হলিউড, তিনি জয় করে নেন পুরো পৃথিবীর মন।
নির্বাক সিনেমার সেই যুগে, চার্লি চ্যাপলিনের অভিব্যক্তিই ছিল ভাষা—হাসির মধ্যেও ছিল গভীর মানবিক বার্তা। দারিদ্র্য, যুদ্ধ, লাঞ্ছনা—সব কিছু ছাপিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, হাসির শক্তি দিয়ে পুরো দুনিয়া বদলে দেওয়া যায়।
০৬. টমাস আলভা এডিসন: এক মায়ের বিশ্বাসে গড়া জিনিয়াস
টমাস আলভা এডিসন—নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি, ফোনোগ্রাফ, চলচিত্রের ক্যামেরা, আধুনিক ব্যাটারিসহ শত শত আবিষ্কারের কথা। ইতিহাসের অন্যতম সেরা উদ্ভাবক হিসেবে তিনি পৃথিবীকে যেভাবে বদলে দিয়েছেন, তাতে গোটা মানবজাতি তাঁর কাছে চিরঋণী।
তবে এই বিস্ময়কর মানুষের জীবন শুরু হয়েছিল সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা দিয়ে।
১৮৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে জন্ম নেওয়া এডিসন ছোটবেলায় ‘স্কারলেট ফিভার’ নামের একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে তিনি প্রায় কানে শুনতেই পেতেন না। তাঁর স্কুলজীবন ছিল মাত্র ১২ সপ্তাহের। কারণ শিক্ষকরা মনে করতেন, টমাস অতিরিক্ত ধীর, মনোযোগহীন এবং নির্বোধ।
একদিন স্কুল থেকে একটি চিঠি দিয়ে তাঁর মা’কে জানানো হয়—
“আপনার ছেলেটি খুবই দুর্বল। আমাদের পক্ষে তাকে আর পড়ানো সম্ভব নয়।”
কিন্তু মা সে চিঠি ছেলেকে পড়ে শোনান এভাবে—
“আপনার ছেলে অতিমেধাবী। এই স্কুলে এমন মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর যোগ্যতা নেই, তাই অনুগ্রহ করে বাসায় রেখে তাকে শিক্ষিত করুন।”
এই একটি মিথ্যে কিন্তু সাহসী বাক্য হয়ে ওঠে ছোট্ট টমাসের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। মায়ের বিশ্বাস আর সাহসেই টমাস শুরু করেন নিজে নিজে শেখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, আর অজানাকে জানার অসীম চেষ্টা।
একসময়, যখন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের জন্য ১০ হাজার বার ব্যর্থ হয়েছেন, তখনো থেমে যাননি। কেউ বললে, “তুমি তো হাজার হাজারবার ব্যর্থ হয়েছো!” তিনি হেসে জবাব দিতেন—
“আমি ব্যর্থ হইনি। আমি শুধু ১০ হাজার উপায় জেনেছি যেগুলোতে এটি কাজ করে না।”
মায়ের মৃত্যুর বহু বছর পর, এডিসন একদিন খুঁজে পান সেই পুরনো স্কুলের চিঠিটি। আসল কথাগুলো জেনে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন—
“আমি এক মেধাহীন শিশু ছিলাম, যার ভেতরের প্রতিভা জাগিয়ে তুলেছিল একজন অসাধারণ মা।”
এডিসনের জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয়—একজন মানুষের বিশ্বাস, আরেকজনের ওপর ভরসা রাখতে পারার শক্তি কতটা বদলে দিতে পারে একটি জীবন। সঠিক সময়ে দেওয়া একটি উৎসাহের বীজও জন্ম দিতে পারে ভবিষ্যতের একজন ইতিহাস-নির্মাতা।
০৭. উইনস্টন চার্চিল: ব্যর্থতার মাঝে লুকিয়ে থাকা সাফল্যের গল্প
১৮৭৪ সালে জন্ম নেওয়া উইনস্টন চার্চিল ব্রিটেনের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও নেতা। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনে সাফল্য আর ব্যর্থতা—দুটোরই গভীর ছাপ রয়েছে, যা থেকে বিশ্বের বহু মানুষ অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে।
চার্চিলের বিখ্যাত উক্তি আজও আমাদের প্রেরণা জুগিয়ে থাকে—
“ব্যর্থতা মানেই সব শেষ নয়; ব্যর্থতার পরেও এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখতে হবে।”
“সাফল্য হলো উৎসাহ হারানো নয়, এক ব্যর্থতা থেকে আরেক ব্যর্থতায় অটল থেকে যাত্রা চালিয়ে যাওয়া।”
এই মহান নেতার জীবনও ব্যর্থতার গল্পে ভরা। রয়্যাল মিলিটারি কলেজে তিনি প্রথম দুইবার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেন। তৃতীয়বারে সুযোগ পাওয়ার পরও তাঁকে কম গ্রেডের বিভাগে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি চার্চিল। পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে তিনি নিজের অবস্থান অনেক ওপরে নিয়ে যান।
রাজনৈতিক জীবনে পাঁচটি নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি কখনো হার মানেননি। কথা বলার ক্ষেত্রেও তাঁর সংগ্রাম কম ছিল না। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তার এই চার্চিল ডিপ্রেশনে ভুগেছেন বহু বছর। ভাষণ দেওয়ার সময় বিশেষ সমস্যায় পড়তেন, যার জন্য তাঁকে বিশেষ ওষুধও নিতে হয়েছিল। তবু, এসব বাধা তাঁর সাহস ও লড়াইয়ের মনোভাবকে থামাতে পারেনি।
চার্চিলের জীবন আমাদের শেখায়—সত্যিকারের নেতা কখনোই ব্যর্থতাকে পরাজয় মানেন না, বরং সেটিকে শক্তি হিসেবে নিয়ে অগ্রসর হন। তাঁর এই যাত্রা আজও কোটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার আলোকস্তম্ভ।
৮.জে কে রাওলিং: সংগ্রাম থেকে বিলিয়ন ডলারের স্বপ্নপূরণ
শুধু বই লিখেই বিশ্বে বিলিয়ন ডলারের মালিক হওয়া মানুষের সংখ্যা খুব কম। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জে কে রাওলিং—যিনি হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা। তাঁর লেখা হ্যারি পটার বইগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সিরিজ, আর সেই সিরিজ থেকে নির্মিত সিনেমাগুলো সব ব্লকবাস্টার হিট। জনপ্রিয়তা ও আর্থিক সফলতার দিক থেকে তিনি নিঃসন্দেহে সাহিত্যের এক কিংবদন্তি।
কিন্তু এই সফলতার পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর সংগ্রামের গল্প। পড়াশোনায় রাওলিং কখনো খুব ভালো ছিলেন না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টেস্টে ফেল করার পর তিনি এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে তিনি পর্তুগালে চলে যান এবং সেখানে একটি অসহ্য জীবনযাপন করেন—যেখানে তাকে অমানবিক নির্যাতন করতে হয়। ১৯৯৩ সালে ৩৮ বছর বয়সে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি বোনের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন।
এই সময়টা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়। তিনি মনে করতেন জীবনে সবকিছুতে ব্যর্থ হয়েছেন। ডিপ্রেশনে ভুগতেন, এমনকি আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। কিন্তু মেয়ের জন্য, নতুন করে আশার বীজ বোনা শুরু করেন তিনি। নিজের লেখালেখির প্রতিভা ঘষে-মাজতে মগ্ন হয়ে শুরু করলেন হ্যারি পটারের গল্প।
দুই বছর কঠোর পরিশ্রমের পর ১৯৯৫ সালে প্রথম বইটির খসড়া শেষ হলো। যখন তিনি বইটি প্রকাশ করার জন্য পাঠালেন, ১৪টি প্রকাশনা সংস্থা প্রত্যাখ্যান করে দিলো। অবশেষে ১৯৯৬ সালে ছোট একটি প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসবারি বইটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলো।
১৯৯৭ সালে হ্যারি পটারের প্রথম বই প্রকাশ হতেই বিশ্বব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। রাওলিং অবাক হয়ে দেখেন, এত ব্যর্থতার পরও তার ধৈর্য ও চেষ্টা তাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে এসেছে। এরপর একের পর এক বই ও সুপারহিট সিনেমার মাধ্যমে তার যাত্রা চলতে থাকে।
২০০৪ সালে তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রথম সাহিত্যিক, যিনি শুধুমাত্র বই লিখে বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন। তাঁর জীবন প্রমাণ করে—যে কেউ ধৈর্য, সাহস ও পরিশ্রম নিয়ে এগিয়ে যায়, সে অন্ধকারের মধ্যেও আলোর সন্ধান পায়।