সফলতার গল্পে সবার আগে যে জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে তা হল, সফলতা কোনো একক ঘটনা নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়ের ফল। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যাদের জীবন একসময় চরম ব্যর্থতায় ডুবে ছিল, কিন্তু তারা নিজেদের চেষ্টায় সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন। তাদের গল্পগুলো অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস।
আসুন, আমরা পনের জন চরম ব্যর্থ মানুষের সফলতার গল্প জানি।
১. থমাস এডিসন
থমাস এডিসন, পৃথিবীর অন্যতম সফল উদ্ভাবক, যাকে আমরা সাধারণত বাল্বের আবিষ্কারক হিসেবে চিনি। কিন্তু তার শৈশবে শিক্ষকরা বলেছিলেন যে, সে কিছুই শেখার মতো নয়। স্কুলে পড়াশোনা করার সময় তার মা তাকে বাইরে বের করে দেয়, কারণ তার শিক্ষক বলেছিল যে সে একদম অক্ষম। তবে থমাস এডিসন হার মানেননি। তিনি দীর্ঘসময় কাজ করে, অবশেষে ১০,০০০টি ভুল পরীক্ষার পর বাল্ব আবিষ্কার করেন, যা আজ বিশ্বের প্রতিটি কোণে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
২. ওপরা উইনফ্রে
ওপরা উইনফ্রে, টেলিভিশনের এক কিংবদন্তি নাম, যিনি একসময় টেলিভিশনে কাজ শুরু করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তার প্রথম টিভি শো “অরফান উইনফ্রে শো” এর আগের শোতে তাকে বলেছিল যে সে “টেলিভিশনে উপস্থাপনার জন্য একেবারে অযোগ্য”। কিন্তু তিনি এই মন্তব্যকে পরাজয়ের মত নিয়ে স্বীকার করেননি। নিজের আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রমের মাধ্যমে, তিনি শোয়ের মাধ্যমে নিজের পরিচিতি তৈরি করেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সফল নারী টিভি সঞ্চালক হয়ে ওঠেন।
৩. স্টিভ জবস
স্টিভ জবস, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা, জীবনেও অনেকবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাকে তার নিজের প্রতিষ্ঠানে, অ্যাপলে, ত্যাগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি একে পরাজয় হিসেবে নেননি, বরং তা তার নতুন সুযোগ খোঁজার প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পরে তিনি ‘নেক্সট’ নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অ্যাপলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটান।
৪. জে. কেটেলিং
জে. কেটেলিং, হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা, তার জীবনে শুরুতেই অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি এক সময় একাধিক প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন। একাধিক পত্রিকা এবং প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেও তিনি লিখতে থামেননি। অবশেষে হ্যারি পটার বইটি প্রকাশ পায় এবং তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল লেখিকাদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন।
৫. মাইকেল জর্ডান
মাইকেল জর্ডান, বেসবল ও বাস্কেটবল বিশ্বে এক কিংবদন্তি নাম, তার শৈশবে স্কুল বাস্কেটবল দলের নির্বাচনে বাদ পড়েছিলেন। তার কোচ বলেছিলেন, তিনি কখনই ভাল খেলোয়াড় হতে পারবেন না। কিন্তু জর্ডান এর বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে থাকেন, কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় মনোভাবের মাধ্যমে তিনি বাস্কেটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন।
৬. হ্যারল্ড জেনকিন্স (এলভিস প্রেসলি)
এলভিস প্রেসলি, যিনি “দ্য কিং” হিসেবে পরিচিত, তার শৈশবের সময় অনেকবার ব্যর্থ হয়েছেন। একবার তিনি গিটার বাজাতে গিয়ে তার শিক্ষককে বলেছেন যে, তিনি গায়িকা হতে পারবেন না। এছাড়া, প্রথমবার যখন তিনি স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতে যান, তখন তাকে বলে হয়েছিল যে তার গায়কির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু প্রেসলি কখনই হাল ছাড়েননি এবং নিজেকে প্রমাণ করে তিনি বিশ্বে সবচেয়ে সফল সঙ্গীত শিল্পীদের একজন হয়ে উঠেছেন।
৭. বিল গেটস
বিল গেটস, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, তার জীবনের শুরুতে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার প্রথম ব্যবসায়িক উদ্যোগ, Traf-O-Data, সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি হাইস্কুলে সেরা ছাত্র ছিলেন না এবং ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম বছরেই ফেল করেছিলেন। তবে বিল গেটস কখনও নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা করে, তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং প্রযুক্তি জগতে বিপ্লব ঘটান।
আরও জানুনঃ কিছু মোটিভেশনাল উক্তি যা আপনার জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে
৮. রিচার্ড ব্র্যানসন (ভিরগিন গ্রুপ)
রিচার্ড ব্র্যানসন, ভিরগিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, তার জীবনেও অনেক বড় ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন। স্কুলে পড়াশোনার সময় তিনি ছিলেন একেবারে অতি গড়পড়তা ছাত্র এবং তার একাধিক ব্যবসা শুরু করার পর তারা ব্যর্থ হয়েছিল। তার প্রথম ব্যবসা ছিল একটি ম্যাগাজিন, যা কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। তারপর, তিনি ভিরগিন রেকর্ডস প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটি খুব সফল হয়, পরে আরও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে ভিরগিন এয়ারলাইন্স অন্যতম। আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।
৯. স্টারলিং আর্কল (কেনা ইউনিভার্সিটি)
স্টারলিং আর্কল ছিলেন এক সময়ের হার্ডওয়্যার ডিজাইনার, যিনি প্রথমবার কাজের জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। একাধিক কোম্পানি তাকে কাজ দিতে অস্বীকার করেছিল এবং বলা হয়েছিল যে তার দক্ষতা পর্যাপ্ত নয়। তিনি হাল না ছেড়ে নিজের স্টার্টআপ শুরু করেন, যা বর্তমানে একাধিক প্রযুক্তি কোম্পানি ও ইউনিভার্সিটির অংশ হয়ে গেছে। তার অদম্য মনোভাব এবং কঠোর পরিশ্রমই তাকে এই সফলতা এনে দিয়েছে।
১০. জ্যাক মা (আলিবাবা)
জ্যাক মা, আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা, তার জীবনেও অনেক বড় ব্যর্থতা ও অস্বীকৃতির সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি স্কুলে একবার ফেল করেছিলেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ২ বার ব্যর্থ হন। যখন তিনি চাকরি খুঁজতে বের হন, তখন ৩০টি কোম্পানি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এমনকি কফি শপে কাজের জন্যও তাকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু জ্যাক মা কখনই হাল ছাড়েননি। দীর্ঘ ১৮ বছর পর, আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করে তিনি চীনের অন্যতম বড় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হয়ে উঠেন এবং বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হয়ে যান।
১১. এভারেস্ট জয়ী বিংগমি তামাং
বিংগমি তামাং, বাংলাদেশের প্রথম নারী, যিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেন। তার জীবনের শুরুর দিকে তিনি একটি পাহাড়ি অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় সবার কাছে তাকে বলা হত যে, তিনি কিছুই পারবেন না, কিন্তু তামাং এই প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোভাব নিয়ে পর্বতারোহী হিসেবে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তোলেন। ২০১২ সালে তিনি এভারেস্টে উঠেন এবং বাংলাদেশে নারী empowerment এর এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন।
১২. চার্লি চ্যাপলিন
চার্লি চ্যাপলিন, ইতিহাসের অন্যতম সেরা কমেডিয়ান, জীবনে বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। তার শৈশবে তাকে অল্প বয়সে orphanage-এ পাঠানো হয়, এবং একসময় তাকে নাট্যজগতে কাজ দেওয়ার জন্য প্রায়ই প্রত্যাখ্যাত করা হতো। এমনকি প্রথম চলচ্চিত্রে তার অভিনয় এতই খারাপ ছিল যে তাকে তার ক্যারিয়ারের জন্য ‘মুখমন্দ’ বলা হয়েছিল। তবে তিনি থেমে না গিয়ে নিজের চেষ্টা চালিয়ে যান, এবং পরবর্তীতে তিনি হলিউডে এক কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন।
১৩. হ্যারল্ড ব্লুম
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় হ্যারল্ড ব্লুম নামক এই লেখক এবং সাহিত্য সমালোচককে তার প্রথম বইয়ের জন্য প্রত্যাখ্যাত করা হয়েছিল। এমনকি তিনি বলেন, “যতবারই আমি আমার কাজ পাঠাতাম, প্রত্যেকবার আমাকে হতাশ হতে হত।” কিন্তু তিনি নিজেকে কখনোই পরাজিত হতে দেননি। তার সাহিত্য সমালোচনার কাজ তাকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়, এবং তিনি পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক চিন্তাবিদদের মধ্যে একে পরিণত হন।
১৪. অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, যিনি বিশ্বকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উপহার দিয়েছেন, তার শৈশব ছিল সবার কাছে এক দুঃখজনক সময়। স্কুলে তার শিক্ষকরা তাকে বলেছিলেন যে, সে মেধাহীন এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন ভবিষ্যত নেই। এ ছাড়াও, বহুবার তাকে বিজ্ঞান এবং গণিতের পরীক্ষায় ব্যর্থ হতে হয়েছিল। কিন্তু আইনস্টাইন তার এই ব্যর্থতাগুলোকে নিজের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং একসময় তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে উঠেন।
১৫. ক্রিস গার্ডনার
ক্রিস গার্ডনার, যিনি “The Pursuit of Happiness’ নামে বিখ্যাত সিনেমার মূল চরিত্র, নিজের জীবনে অন্ধকার সময় অতিক্রম করেছেন। একসময় তিনি ছিলেন একজন ব্যর্থ ব্যবসায়ী, যার কাছে না ছিল বাড়ি, না ছিল কোনো আশ্রয়। তিনি নিঃস্ব ছিলেন এবং তার ছোট ছেলে ছিল যার দায়িত্ব তার উপর ছিল। কিন্তু ক্রিস গার্ডনার কখনো হাল ছাড়েননি, কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্যমের মাধ্যমে তিনি একদিন একটি বড় বিনিয়োগ ব্যাংকের সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। তার জীবনের সংগ্রাম এবং সাফল্য আমাদের শেখায়, কখনোই হার মানা উচিত নয়।
এই গল্পগুলো প্রতিটি মানুষের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা। আমাদের জীবনে ব্যর্থতা আসবে, তবে তা আমাদের পরবর্তী সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ হতে পারে। তারা প্রমাণ করেছেন যে কঠোর পরিশ্রম, সংকল্প, এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যর্থতাকে জয় করা সম্ভব।
গল্পগুলো আমাদের শেখায় যে ব্যর্থতা কখনই চূড়ান্ত নয়। এটা শুধুমাত্র একটি ধাপ, যা আমাদের পরবর্তী সফলতার দিকে নিয়ে যায়। তারা সকলেই কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তারা নিজেকে পরাজিত হতে দেননি। তাদের প্রতিটি গল্পে আমরা দেখতে পাই যে, আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম, এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
তাহলে, আপনার পথ চলাতেও যদি ব্যর্থতার মুখোমুখি হন, তাহলে মনে রাখবেন—এটাই আপনার শেষ নয়, বরং নতুন এক সম্ভাবনার সূচনা।